ধার্মিকেরা কেন এত উন্মক্ত হয়ে ওঠে?

আরজ আলী মাতুব্বর আমার কাছে সব সময়েই ছিলেন বিষ্ময়ের। একজন মুসলিম থেকে নাস্তিক হয়ে উঠবার পেছনে তাঁর যে ইতিহাস সেটা বড় বেদনার। তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের মৃত মুখের একটা ছবি তোলার অপরাধে আরজ আলীর মায়ের মৃত দেহ কেউ দাফনে রাজী হন নি। আরজ আলী মাকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন। ধর্মের দোহাই দিয়ে তাঁর মৃত মাকে এই অসম্মান আরজ আলী মেনে নিতে পারেন নি। সেই থেকেই আরজ আলী ধর্মের প্রতি বিশ্বাস হারান। বদলে যান পুরো দস্তুর। তিনি ধর্ম, ধর্মের নিয়ম, ধর্মের ব্যবস্থা, কাঠামো নিয়ে অসংখ্য কৌতূহলী প্রশ্ন করতে থাকেন একের পর এক।

ঢাকায় থাকতে প্রতি জুম্মাবারে শ্যামলীর এস ও এস শিশুপল্লী মসজিদে আমি নামাজ পড়তে যেতাম। সেই মসজিদে ইমাম তাঁর আরবী খুতবার আগে ইচ্ছেমত ইহুদি আর নাসারাদের এক চোট ধুয়ে দিতেন। আমি খুব অসহায় বোধ করতাম সে সময়। মসজিদে যেতাম আল্লাহকে দেখবার জন্য, পাবার জন্য, তাঁর প্রেমে পড়বার জন্য অথচ সেখানে গিয়ে শুধু পেয়েছি ঘৃণার পাঠ। ইহুদি ভালো না, নাসারা ভালো না, শিয়া ভালো না, হিন্দু ভালো না শুধু ভালো মুসলমান। অথচ এই মসজিদ থেকেই মানুষের জুতা চুরি হয় প্রতিনিয়ত। অথচ সেই ইমাম যে মাইক দিয়ে কথা বলেন, যে বিদ্যুৎ দিয়ে মাইক চালান, আলো জালান যে বাতি দিয়ে, যে টেকনোলজি তাঁর মাথার উপরের এই ছাদ বানিয়ে দিয়েছেন সবই বানিয়েছে এই ইহুদি আর নাসারা বিজ্ঞানীরা। সে কথা ইমাম হয়ত ভেবেও দেখেন নি।

আমি একটা সময় মসজিদে যাওয়া বাদ দিলাম। জুম্মার নামাজ ঘরে পড়লে নাকি হয়না তাই আর জুম্মার নামাজও আমার আর হলোনা। মাঝে মধ্যে ঘরে নামাজ পড়তাম, তাও নিয়ম করে নয়।

মানুষ আজও বের করতে পারেনি সে কোথা থেকে এলো, মানুষ আজও জানেনা এই পৃথিবীর শুরুর আগে কি ছিলো বা শুরুটাই কিভাবে হোলো। সুতরাং এসব প্রশ্নের টু দা পয়েন্ট অকাট্য প্রমাণ হাজির করার আগ পর্যন্ত মানুষ ধর্মে বিশ্বাস করবে। মানুষ তাঁর স্রষ্ঠাকে খুঁজে বেড়াবে। এটাই আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়।কিন্তু যারা কোনো সৃষ্টি কর্তাকে বিশ্বাস করেন না, যারা ধর্ম বিশ্বাস করেন না তাঁরা কি করবেন? তাঁরা যদি প্রশ্ন তোলেন যে মেরাজে কিভাবে যাওয়া সম্ভব, কিভাবে কারো সাথে যৌন সম্পর্ক ছাড়া মাতা মেরী যীশুর জন্ম দিলেন, কেউ যদি প্রশ্ন তোলেন গনেশের পায়ের নীচে দুধ রেখে কি হবে, কেউ যদি প্রশ্ন তোলেন যে একজন দেবীর এত হাত কিভাবে হবে কিংবা কেনই বা একজন দেবীকে নিজের হাতে গড়ে তাকে আবার পানিতে ডুবিয়ে দাও, কিংবা কোরান শরীফ কিভাবে গায়েবী ওহীতে আসে?

তাহলে কি এসব প্রশ্নকে আপনি বা আমি অমূলক প্রশ্ন বলতে পারি? আমার দৃষ্টিতে আমি বা আমরা পারিনা। আধুনিক বিজ্ঞান, আধুনিক প্রযুক্তি, এই এগিয়ে চলা পৃথিবীতে এসব প্রশ্ন একজন স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের মনে আসবে আর এটাই হওয়া উচিৎ। কিন্তু এসব প্রশ্ন কেউ করলেই আমরা এত রেগে যাই কেন? কেন আমরা এত ভয়াবহ আতংকে অস্থির হয়ে উঠি? এক বিশ্বাস করা ছাড়া কি যুক্তি আমাদের মুসলিমদের রয়েছে? কি যুক্তি রয়েছে হিন্দু, খৃষ্ঠান, বৌদ্ধ, শিখদের? কি যুক্তি রয়েছে এসব প্রশ্নের জবাবে?

মানুষের এইসব অদম্য কৌতূহলকে আমরা কেন মেনে নিতে পারিনা? আরজ আলী মাতুব্বরের বই তাই আমার জন্য এক পরম কৌতূহলের। আমি যেমন মেরাজের পুরো কাহিনীকে এক ধরনের হাস্যকর রূপকথা বলে বিশ্বাস করি, ঠিক তেমনি আরজ আলী মাতুব্বরের প্রশ্নগুলো আমার বুকে অসংখ্য প্রশ্নের জন্ম দেয়।

যেদিন থেকে বুঝেছি এই জীবন শুধু একটা সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য, শুধু একটা সামান্য সময়ের প্রয়োজনে সেদিন থেকে মানুষের এই প্রশ্ন আর বিশ্বাস এই দুইটি উপাদানকেই আমি মেনে নিয়েছি। আমি বুঝেছি বিশ্বাস, সংশয়, প্রশ্ন, উত্তর, কৌতূহল এসব নিয়েই এই সামান্য জীবন আমাদের।

এই সামান্য সময়টাই মানুষের জন্য বড় বিষ্ময়ের, বড় কৌতূহলের। মানুষ এখানে বিশ্বাস করবে আবার মানুষই অবিশ্বাস করবে। মানুষই মেনে নেবে স্রষ্ঠা আছে বলে আবার মানুষই মেনে নেবে না কোনো স্রষ্ঠাকে। পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে এত স্বাভাবিক লাগে, অথচ ধর্ম, ধর্মের কাঠামো, ধর্মের ব্যবস্থা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুল্লেই আমরা ধার্মিকেরা এত উন্মক্ত হয়ে উঠি কেন?

তবে কি আমরা আমাদের যুক্তিহীন বিশ্বাস নিয়ে লজ্জিত? তবে কি আমাদের বিশ্বাস খুব ঠুনকো? তবে কি আসলে আমরা শুধু পরজীবনে পাবার জন্যই কেবল বিশ্বাস করি আর সেটির যাত্রায় কেউ ভিন্ন ন্যারেটিভ রচনা করলে আমরা অসহায় বোধ করি?

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *